চীনের উপর আরোপিত বিভিন্ন অসম চুক্ত গুলির বিবরণ দাও
সূচনা: উনবিংশ ও বিংশ শতকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি ইউরােপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি চিনকে বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত করে এবং নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্যের প্রসার ঘটিয়ে তার ওপর বেশ কয়েকটি একতরফা শােষণমূলক চুক্তি চাপিয়ে দেয়। এই চুক্তিগুলি সাধারণভাবে ‘অসম চুক্তি’ বা ‘বৈষম্যমূলক চুক্তি’ নামে পরিচিত।
নানকিং এর চুক্তি:- ব্রিটিশরা চীনে আফিম এর ব্যবসা শুরু করলে চীনারা ধীরে ধীরে আফিমের নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। চীনের সম্রাট মাঞ্চু চিন্তিত হয়ে এই ব্যবসা বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়। ফলে ইংরেজদের সঙ্গে চীন সরকারের যুদ্ধ বাধে 1840 সালে। চীন সম্রাট পরাজিত হলে 1842 সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে নানকিং এর সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়।সন্ধির শর্তাবলি: নানকিং-এর সন্ধির দ্বারা- [a] ক্যান্টন, সাংহাই, অ্যাময়, ফুচাও, নিংপােচিনের এই পাঁচটি বন্দর ইউরােপীয় বণিকদের বাণিজ্য ও বসবাসের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
বগ–এর চুক্তি: নানকিং-এর সন্ধির কিছুকাল পর ব্রিটিশ সরকার চিনের ওপর বগ-এর সন্ধি (১৮৪৩ খ্রি.) চাপিয়ে দেয়। এই সন্ধির দ্বারা ব্রিটেন চিনে কিছু ‘অতি রাষ্ট্রিক অধিকার’ (Extra-Territorial Rights) লাভ করে। এই চুক্তির দ্বারা: [i] চিন অন্য কোনাে বিদেশি রাষ্ট্রকে ভবিষ্যতে যেসব সুযােগসুবিধা দেবে সেগুলি ব্রিটেনকেও দিতে প্রতিশ্রুতি দেয়।
ওয়াংঘিয়ার চুক্তি: অন্যান্য ইউরােপীয় শক্তিগুলি চিনের কাছ থেকে বেশ কিছু বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করলে দুর্বল চিন আমেরিকার সঙ্গে ওয়াংঘিয়ার চুক্তি (১৮৪৪ খ্রি., ৩ জুলাই) সাক্ষর করে। এই চুক্তির দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনে বিভিন্ন অতি রাষ্ট্রিক সুবিধা লাভ করে।
আরো পড়ুন
দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের সমস্ত অধ্যায় থেকে বড়ো প্রশ্ন উত্তর পেতে ক্লিক করুন
হােয়ামপােয়ার চুক্তি: ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর ফ্রান্স চিনের ওপর হােয়ামপােয়ার চুক্তি চাপিয়ে দেয়। চিনের কাছ থেকে ব্রিটেন ইতিমধ্যে যেসব সুযােগসুবিধা আদায় করেছিল ফ্রান্সও হােয়ামপােয়া চুক্তির দ্বারা সেসব সুযােগসুবিধা আদায় করে। এই সন্ধির দ্বারা: [i] চিনের নতুন পাঁচটি বন্দর ফরাসি বণিকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। [ii] ফরাসি নাগরিকরা চিনে অতি-রাষ্ট্রিক সুবিধা লাভ করে।
আইগুনের অসম চুক্তি: ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কাছে দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধে (1856 খ্রিষ্টাব্দ) চীন বিপর্যয়ের মুখে পড়লে, সেই সুযোগে প্রতিবেশী রাশিয়া-চীনের উপর ‘আইগুনের অসম চুক্তি’ চাপিয়ে দেয়। (1858 খ্রিস্টাব্দ)
চুক্তির শর্তাবলীঃ– (i) এই চুক্তির দ্বারা চীনের উত্তর দিকের বেশ কিছু এলাকায় রাশিয়া তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
(ii) চীনের আমুর,উসুরি, সংঘুরা জিয়া নদীতে একমাত্র রাশিয়া ও চীনের নৌচলাচল স্বীকৃত হয়।
তিয়েন সিয়েনের অসমচুক্তি: দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধের পরাজিত হলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স টিনের উপর এই চুক্তি চাপিয়ে দেয়। (1858 খ্রিস্টাব্দে)চুক্তির শর্তাবলীঃ-
(i)এই চুক্তির দ্বারা চীন সরকার ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স কে প্রচুর পরিমাণের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়।
(ii) বিদেশী বণিকদের জন্য আরও 11 টি বন্দর খুলে দেওয়া হয়
সিমনোসেকির সন্ধি :- চিনের কোরিয়ার ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে চিন-জাপান যুদ্ধ (১৮৯৪-৯৫ খ্রি.) শুরু হয়। এই যুদ্ধে হেরে চিনের ওপর জাপান শিমােনােসেকির সন্ধি (১৮৯৫ খ্রি.) চাপিয়ে দেয়। এর ফলে কোরিয়াকে চিন স্বাধীনতা দেয় চিনের কাছ থেকে জাপান পেস্কাডােরেস, তাইওয়ান, লিয়াও টুং উপদ্বীপ ও পাের্ট আর্থার লাভ করে। চিন তার বেশ কয়েকটি বন্দর জাপানের জন্য খুলে দেয়।
বক্সার প্রটোকল : চিং (বা কিং) বংশের শাসনকালে চিনে বিদেশি শক্তির নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে আই-হো-চুয়ান নামে এক গুপ্ত সমিতি বক্সার বিদ্রোহ করে।(1899-1901 খ্রিষ্টাব্দ) শেষ পর্যন্ত বিদেশী শক্তির কাছে চীন পরাজিত হলে ‘বক্সার প্রটোকল’ চুক্তি করতে বাধ্য হয়।(1901 খ্রি:)
শর্তাবলীঃ– (i)এর দ্বারা চীনের ওপর বিরাট ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয়। (ii) চীন সরকার প্রতিশ্রুতি দেয় বিদেশী বণিকদের কাছ থেকে 5 শতাংশের বেশি শুল্ক আদায় করবে না।
উপসংহার: চিনে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকা যেসব অতিরাষ্ট্রিক সুযােগসুবিধা লাভ করেছিল তা অন্তত ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বজায় থাকে। চিনের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেন ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে হংকং-এর ওপর এবং পাের্তুগাল ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ম্যাকাও-এর ওপর তাদের দাবি ত্যাগ করে।
আরো পড়ুন
দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের সমস্ত অধ্যায় থেকে বড়ো প্রশ্ন উত্তর পেতে ক্লিক করুন