উপনিবেশিক ভারতে অবশিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।
অবশিল্পায়ন:- অবশিল্পায়নের আক্ষরিক অর্থ হল- শিল্পের অবনমন বা শিল্পের অধোগতি। অবশিল্পায়ন বলতে বোঝায় মূলত শিল্পায়নের বিপরীতমুখী ধারা অর্থাৎ অর্থনীতিতে যদি শিল্পের গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং একইসঙ্গে কৃষির গুরুত্ব বাড়তে থাকে তবেই তা অবশিল্পায়ন হিসেবে ধরা হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে একদিকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব, কোম্পানির অসম শুল্ক নীতি ও অত্যাচার এবং অন্যদিকে দেশীয় অভিজাত শ্রেণির অবক্ষয়ের ফলে বাংলার তাঁত-বস্ত্রশিল্পসহ অন্য শিল্পের কারিগররা ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল, একেই- অবশিল্পায়ন বলা হয়।
মূলধনের অভাব : আঠারাে শতকে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রের ব্যবহার ঘটিয়ে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটানাে সম্ভব হয়েছিল মুলধনের জোগান থাকায়। কিন্তু ভারতে মূলধনেরজোগান দেওয়াতাে দূরের কথা এদেশের অর্থ ও সম্পদকে কোম্পানি নিংড়ে শােষণ করে নিয়েছিল। ফলে মূলধনের অভাবে অবশিল্পায়ন ছিল এক অবশাম্ভাবী ঘটনা।
অবাধ বাণিজ্যনীতি : ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের মাধ্যমে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকারের অবসান ঘটিয়ে অবাধ বাণিজ্যনীতি গৃহীত হয়। ফলে ইংল্যান্ডের অন্যান্য বণিক সম্প্রদায়ও এবার থেকে অবাধে ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করে। ইংল্যান্ডে উৎপাদিত কৃষিনির্ভর পণ্যসামগ্রীতে ভারতীয় বাজার ছেয়ে যায়।
আরো পড়ুন
দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের সমস্ত অধ্যায় থেকে বড়ো প্রশ্ন উত্তর পেতে ক্লিক করুন
শিল্পবিপ্লব: ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটে যাওয়ায় অনেক কম সময়ে বেশ উন্নতমানের অথচ সস্তা দ্রব্য উৎপাদন শুরু হয়, যা সহজে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন বাজার দখল করে নেয়। এ প্রসঙ্গে ড. রমেশচন্দ্র দত্ত বলেছেন- ইউরােপের পাওয়ার লুমের আবিষ্কার ভারতীয় শিল্পের বিনাশকে সম্পূর্ণ করেছিল (The invention of Powerloom in Europe completed the decline of the Indian Industries)
অসম শুল্ক নীতি : কোম্পানি নিজে বিভিন্ন পণ্যের ওপরে শুল্ক ছাড়ের সুযােগ নিলেও ভারতে উৎপাদিত শিল্পপণ্য এবং দ্রব্যগুলির ওপর বিশাল শুল্কের বােঝা চাপায়। ইংল্যান্ড থেকে আগত শিল্পদ্রব্যগুলির ওপর কোনাে কর না চাপানােয় শিল্পপণ্যেরদামের ক্ষেত্রে প্রতিযােগিতায় ভারতীয় শিল্পবণিকরা পিছিয়ে পড়তে থাকে।
অবশিল্পায়নের ফলাফল :- অবশিল্পায়নের সুফল কিছুই ছিল না বরং ভারতীয় অর্থনীতিতে অবশিল্পায়নে একাধিক কুফল লক্ষ্য করা যায়।এই ফলাফল গুলি হল নিম্নরূপ-
ভারতীয় শিল্প বিপর্যয়:- এই অবশিল্পায়নের ফলে ভারতীয় তাঁত, বস্ত্র শিল্প, কুটির শিল্প সহ একাধিক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ভারতে সনাতনী কারিগরি শিল্প মূলত বস্ত্রশিল্প গভীর বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল।
কৃষিকাজের গুরুত্ব বৃদ্ধি :-অবশিল্পায়নের ফলে বিভিন্ন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলি বাধ্য হয়ে কৃষিকাজ করা শুরু করেন। ফলে শিল্পের গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং একইসঙ্গে কৃষির গুরুত্ব বাড়তে থাকে। যার কারণে কৃষিজমি ও শ্রমিকের ওপর চাপ বেড়ে গিয়েছিল।
কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ:- অবশিল্পায়নের ফলে ভারতবর্ষ একটি কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়। এখানকার কাঁচামাল সস্তায় ক্রয় করে ইংরেজ বণিকরা ইংল্যান্ডে রপ্তানি করতে থাকে। ভারতের কাঁচা তুললা, কাঁচা রেশম, নীল, চা প্রভৃতি কাঁচামাল নিয়মিত বিলাতের কারখানাগুলিতে চলে যেতে থাকে। এর ফলে ইংল্যান্ডের শিল্পায়নে গতি আসে।
দারিদ্রতা ও দুর্ভিক্ষ:- অবশিল্পায়নের ফলে ভারত একটি ধনী ও প্রথম শ্রেণীর অর্থনীতির দেশ থেকে “দরিদ্র” দেশে রূপান্তরিত হয়। দারিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী ভারতীয় জনজীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে।
নগরজীবনের অবক্ষয়:- অব-শিল্পায়নের ফলে ভারতের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ শহর গুলির অবক্ষয় শুরু হয়। অষ্টাদশ শতকে মুরশিদাবাদ, সুরাট, মসুলিপট্টম, ঢাকা, তাঞ্জর প্রভৃতি নগর ক্রমে জনবিরল হতে থাকে এবং নগরের অবক্ষয় শুরু হয়।
অবশিল্পায়নকে বহু সমালোচক, গবেষক অলীক কল্পনা বলে উল্লেখ করেছেন। অবশিল্পায়ন ‘অলীক কল্পনা’ কি না এ নিয়ে ডেনিয়েল থর্নার, মরিস ডেভিড মরিস, স্যার থিওডোর মরিসন প্রমুখের মধ্যে তীব্র মতভেদ রয়েছে। মার্কিন গবেষক মরিস ডেভিড মরিস বলেছেন, অবশিল্পায়নের ধারণা জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের প্রচারিত এক অলীক কল্পনা। কিন্তু ড. সব্যসাচী ভট্টাচার্য, ড. অমিয় বাগচি, ড. তপন রায়চৌধুরী, ড. বিপান চন্দ্র প্রমুখ মনে করেন অবশিল্পায়ন একটি বাস্তব ঘটনা এবং তা ভারতবাসীকে দুঃখদুর্দশার তিমিরে নিক্ষেপ করেছিল।
আরো পড়ুন
দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের সমস্ত অধ্যায় থেকে বড়ো প্রশ্ন উত্তর পেতে ক্লিক করুন